সেতুই যখন তাদের শেষ ভরসা

সেতুই যখন তাদের শেষ ভরসা

চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। এখানেই পাটখড়ির বেড়া দিয়ে তুলেছেন ছোট এক কামরার ঘর। ঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন সেতুর পাটাতন। সূর্যের আলো চারপাশ আলোকিত করলেও সে আলো পৌঁছায় না ঘরের ভেতর। সামনেই রয়েছে স্রোতস্বিনী নদী। আশপাশে নেই কোনো নলকূপ। তাই নদীর পানিই দৈনন্দিন ভরসা।

মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের টেকেরহাট বাজারের পাশের একটি সেতুর নিচে স্ত্রী মেহেরজান বেগমকে (৬৫) নিয়ে এভাবেই বসবাস করছেন নুরজামান শিকদার (৭০)। দাম্পত্য জীবনের ৩০ বছরের মধ্যে সাত বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এই ইউনিয়নে।

বয়সের ভারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক আগেই। এক পা অচল ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন স্বামী। স্বাভাবিক জীবনযাপনেও অক্ষম তিনি। স্ত্রীর অন্যের বাড়ি থেকে চেয়েচিনতে আনা চাল-ডাল বা খাবারের বাড়তি অংশ দিয়েই চলে দৈনন্দিন আহার।

নুরজামান শিকদারের জন্মস্থান বরিশাল বাকেরগঞ্জ থানায়। আর স্ত্রী মেহেরজানের জন্মস্থান মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের মহিষেরচর গ্রামে।

জানা যায়, ঢাকার মালিবাগ এলাকায় থেকে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন নুরজামান। মেহেরজানও মালিবাগ এলাকায় থাকতেন। সেখানে ইট ভাঙার কাজ করতেন। একদিন পরিচয় হয় তাদের। পরে বিয়ে করেন তারা। বিয়ের পর মালিবাগ এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন তারা। নুরজামান ঠেলাগাড়ি চালিয়ে আর মেহেরজান ইট ভাঙার কাজ করে ঘোরাচ্ছিলেন সংসার নামক চাকা।

কিন্তু বেশি দিন ঘোরেনি সেই সুখচাকা। কারণ একদিন ঠেলাগাড়ির চাকার নিচে পড়ে নুরজামান হারান একটি পা। বন্ধ হয়ে যায় তার ঠেলাগাড়ি চালানো। তাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। কারণ মেহেরজানের কম রোজগার দিয়ে বাসা ভাড়াও চলছিল না। চিন্তায় পড়েন তারা।

পরে মেহেরজানের এক ভাগনে তাদের মাদারীপুরে চলে আসতে বললে তারা চলে আসেন। মাদারীপুরে এসে তারা খোয়াজপুর ইউনিয়নের টেকেরহাট বাজারের সঙ্গে বেইলি ব্রিজের (বর্তমানে পাকা সেতু) সঙ্গে একটি চায়ের দোকান দেন। থাকার কোনো জায়গা না থাকায় দোকানই তাদের ভরসা। কয়েক বছর পর পাকা সেতু করার উদ্যোগ নিলে তাদের দোকানটিও বন্ধ হয়ে যায়। সেতুর কাজ শেষ হলে আবার আশ্রয় নেন সেতুর নিচে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নুরজামান শিকদার ও তার স্ত্রী ঘরের সামনে বিষণ্ন মনে বসে আছেন। ১০ থেকে ১২ ফুট আয়তনের একটি খুপরি। তাও আবার জরাজীর্ণ দুর্বিষহ অবস্থা। চারপাশে পাটখড়ির বেড়া, ওপরের সেতুটিই মাথা ঢাকার ঠাঁই। নদীর পানি বাড়ায় পানি ঘর ছুঁইছুঁই করছে। ঘরের ভেতর পুরোনো কাপড়-চোপড়। ঘরের পাশেই রান্নাঘর। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাঁড়ি-পাতিল।

তবে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বেড়ে উঠে পড়ে ঘরে। তখন কয়েক মাসের জন্য তাদের চলে যেতে হয় অন্য কোনো আশ্রয়ে। জায়গা-জমি, সহায়-সম্পদ বলতে কিছুই নেই তাদের। ফলে বাধ্য হয়ে এখানেই বসবাস করছেন সাত বছর ধরে।

জানতে চাইলে মেহেরজান বেগম বলেন, আগে ভারী কাজ করতাম। এখন আর পারি না। মানুষের থেকে চাইয়া আইন্না খাইতে হয়। চেয়ারম্যান, মেম্বারগো কাছে গ্যালে কয়, আমি কী করমু? তোমরা যা মন চায় করো গা। মেম্বর ৫০০ টাকা দিছিল। তাও দুবছর আগে। থাকার জাগা নাই। তাই সরকারি জায়গায় থাহি। এখানেও থাকতে অনেক অসুবিধা। মরার পর নিজের জাগায় যাতে দাফন হয়, তাই সরকার আমাগো থাকার একটু জাগা দিলে ভালো হইত।

নুরজামান শিকদার বলেন, নদীর পানি দিন দিন বাড়তাছে। ঘরে পানি উইড্ডা যাইতে পারে কিছুদিন পর। এ্যামনিতেই অনেক কষ্ট করে থাকি। কোনো কামাই-রুজি নাই আমার। পঙ্গু পা নিয়া চলতে-ফিরতে পারি না। আবার শ্বাসকষ্টের অসুখ। প্রত্যেক দিন ওষুধ কিনা লাগে। মানুষের সাহয্যেই বাইচ্চা আছি। থাকার একটা ঘর পাইলে শেষ বয়সে একটু ভালো হইত।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে এনেই তাদের খেতে হয়। দুজনেই বৃদ্ধ ও অসুস্থ হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। সরকারিভাবে এখনো কোনো সহযোগিতা পাননি। তারা খুবই অসহায়। তাই সরকারের তাদের সহযোগিতা করা উচিত।

নুরজামান-মেহেরজানের কোনো সন্তান নেই। স্ত্রী বয়স্কভাতা পেলেও পাচ্ছেন না স্বামী। লকডাউনের সময় কয়েক দফা ত্রাণ পেয়েছিলেন তারা। তা ছাড়া আর কখনো কোনো সরকারি সহযোগিতা পাননি। একাধিকবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েও কোনো ফল হয়নি বলে জানান তারা।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জয়নাল আবেদীনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন এবং তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করে আসছেন। সব সময় তাদের খেয়াল রেখে আসতেছেন। আগামীতেও অসহায় এ পরিবারের পাশে থাকবেন বলে জানান তিনি।

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, বর্তমান সরকার সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করছে। আমি বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। সত্যিই যদি তারা অসহায় ও বাসস্থানহীন হয়ে থাকে, তাহলে তাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

আপনি আরও পড়তে পারেন